হাওরাঞ্চলের কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে
- আপলোড সময় : ০১-১২-২০২৫ ১১:৩৬:১৭ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০১-১২-২০২৫ ১১:৩৬:১৭ অপরাহ্ন
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় জেলা কৃষক সংগ্রাম সমিতির সম্মেলনে যে দাবিগুলো উঠে এসেছে তা হল- হাওরাঞ্চলের নদ-নদী খনন, ইজারা প্রথা বাতিল, কৃষি উপকরণের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ। এগুলো কোনো নতুন কথা নয়; বরং বহু বছরের বঞ্চনা, শোষণ ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এ অঞ্চলের কৃষক, জেলে ও প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকা সরাসরি নির্ভর করে প্রকৃতি, পানি ও মাটির উপর। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের ভুল, দুর্নীতি, অনিয়ম ও অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্যে হাওর যেন প্রতিনিয়ত মৃত্যুমুখী হয়ে পড়ছে।
হাওরাঞ্চলের নদীগুলো দীর্ঘদিন ধরে খননবিহীন পড়ে আছে। সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনার মতো প্রধান নদীর অববাহিকায় পলি জমে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে; ফলে অকাল বন্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা ফসলের মাঠ ও গ্রামীণ জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনছে। এই অব্যবস্থাপনার দায় কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের নয়; বরং সমন্বয়হীনতার শিকার গোটা নদী ব্যবস্থাপনা।
কৃষক নেতাদের দাবি অনুযায়ী নদী খনন যদি জরুরি ভিত্তিতে শুরু না হয়, তবে হাওরাঞ্চলের কৃষি উৎপাদন আরও কমে গিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে - এ আশঙ্কা অমূলক নয়। ইজারা প্রথা বহু আগেই অকার্যকর ও বৈষম্যমূলক প্রমাণিত হয়েছে। একসময় যেসব ‘ওয়াটার লর্ড’ পুরো হাওরাঞ্চলে সন্ত্রাস, লুটপাট ও কৃষক-জেলেদের উপর নিপীড়ন চালিয়েছিল, তাদের প্রভাব কমলেও ইজারা প্রথা এখনো কৃষকদের স্বাধীনতা ও জীবিকার পথে বড় বাধা। খাল-বিল, ডোবা - যেসব জলাধার কখনোই ইজারায় ছিল না, সেখানে নতুন করে খাস কালেকশনের নামে ইজারা চালু হওয়া নিঃসন্দেহে এক ধরনের সামাজিক দমননীতি। এর ফলে কৃষক-জেলেদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ানো, স্থানীয় বিরোধ বাড়ানো এবং অসাধু চক্রের লুটপাটের সুযোগ বাড়ছে।
এদিকে কৃষি উপকরণের দামও নিয়ন্ত্রণহীন। সার, বীজ, কীটনাশকের বাড়তি মূল্য কৃষকদের উৎপাদন খরচ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষি এখন আর কৃষকের জন্য টেকসই পেশা নয়। এনজিও ঋণের বোঝা, দারিদ্র্যের বেড়ে যাওয়া এবং কৃষির প্রতি নিরুৎসাহ - এসব একে একে কৃষকের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করছে। এ অবস্থায় কৃষক সংগ্রাম সমিতির আন্দোলনকে কোনো দলীয় আন্দোলন হিসেবে দেখা নয়; এটি কৃষকজীবনের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো কৃষককে উপকরণ দেওয়া, শোষণ থেকে রক্ষা করা এবং কৃষিকে লাভজনক করে তোলা।
বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ - এ কথা শুধু মুখের বুলি নয়। দেশের খাদ্য সরবরাহ, অর্থনীতি, গ্রামীণ স্থিতিশীলতা সবকিছুই কৃষকের ঘামে ভেজা মাটির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তাই হাওরাঞ্চলের সংকট সমাধান কেবল একটি জেলার সমস্যা নয়; এটি জাতীয় অগ্রাধিকারের বিষয়।
আমরা চাই- হাওরাঞ্চলের নদীগুলো দ্রুত খননের জন্য টেকসই ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পুরো ইজারা প্রথার পুনর্মূল্যায়ন করে জনস্বার্থবিরোধী ইজারা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। কৃষি উপকরণের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি পর্যবেক্ষণ ও বাজার মনিটরিং কঠোর করতে হবে। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে কার্যকর কৃষি বিপণন কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। হাওরপাড়ের মানুষের জীবিকা রক্ষায় মধ্যস্বত্বভোগী, দুর্নীতিবাজ আমলা ও অসাধু চক্রকে কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে।
কৃষকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা শুধু কৃষকের দাবি নয়- এটি জাতির দাবি। হাওরাঞ্চলের কৃষক বাঁচলে, কৃষি বাঁচবে; আর কৃষি বাঁচলে দেশও টিকে থাকবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ

সম্পাদকীয়